Header Ads

জকপুরের মহিশা গ্রামের মনসা মন্দির । jakpur manasa mandir

 দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখার জকপুর ও মাদপুর স্টেশনের মাঝে মহিশা গ্রাম। এই গ্রামে ধান জমির মাঝখানে ছিল উই এর ঢিপি। আর সেখানে মাঝে মাঝেই সাপের উপদ্রব হয়। তাই গ্রামের চাষিরা জমিতে আবাদ করতে যাওয়ার সময় সাপের অঘটন থেকে বাঁচার জন্য ভয় আর ভক্তি থেকেই

এখানে ওই উই ঢিপি তে শুরু করে মা মানস দেবীর পুজো।

নদীমাতৃক দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর । সেখানে যেমন আছে নদীর জলে পুষ্ট সবুজ গভীর জঙ্গল ঠিক তেমনি আছে ঐ জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে অগুন্তি সরীসৃপের পরিবার । ছোট বড় নদীর জল , ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা এই সরীসৃপদের মধ্যে বাংলার বিখ্যাত সব সাপেরা গড়ে তুলেছে এক সুন্দর ইকোসিস্টেম । তাদের খুব পছন্দের জায়গা পশ্চিমবাংলার এই স্থানটি । ঘন জঙ্গলের মধ্যে সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, বানভাসি শ্রাবণ-ভাদ্রের থৈ থৈ নদীর দুকুল ছাপিয়ে জল ও চলে আসে সেই জঙ্গলে আর মনের সুখে দিন যাপন করে শঙ্খচূড়, কালনাগিনী, গোখরো, খরিস, চন্দ্রবোড়া সমেত আরো নানা অজানা সাপেরা । এদিকে এই বিশাল জেলায় আছে অঢেল চাষযোগ্য জমি । তাই কৃষকেরা রোজ মা মনসাকে স্মরণ করে ক্ষেতে যায় চাষ করতে । শীতে একটু আরাম । সাপেরা তখন হাইবারনেট করে, গর্তের নীচে শীতঘুম দেয় কিন্তু প্রচন্ড গরমের দাবদাহে বাইরে চলে আসে । বর্ষায় দেখায় উদ্দাম নৃত্য। 




লোককথা অনুসারে এই মন্দিরের ইতিহাস  


 পশ্চিম মেদিনীপুরের জকপুরের কাছে এমন এক জঙ্গল আছে যাকে গ্রামের মানুষেরা মনসার জঙ্গল বলে । ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ পাশে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তারিত এক গভীর খাল ছিল । বর্ষার সময় অতিবৃষ্টিতে ঐ খাল দিয়ে খড়গপুর সহ পশ্চিমের উঁচু জায়গায় বৃষ্টির জল হৈ হৈ করে বয়ে যেত পুব দিকে আর বন্যার আকারে জমেই থাকত সেখানে । শরতের কাশফুলের রমরমায় খালপাড় তখন মেতে উঠত পুজোর আনন্দে । এখানকার কৃষকেরা মনের আনন্দে ধানচাষ করে আরভাদু পরব উদ্‌যাপন করে মনের আনন্দে কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটু অশান্তি সর্বক্ষণের ...ঐ সর্পকুলে বসবাসের জন্য । মা মনসাকে সর্বদা স্মরনে-মননে রাখে । শ্রাবণ-ভাদ্রের শনি-মঙ্গলবারে মনসার পুজো দেয় । শুধু সাপের কারণেই নয় মনসাকে তারা কৃষিদেবী রূপেও মানে । তাদের রুজি-রোজগার, সম্বচ্ছরের খোরাকি সব ঐ ধান চাষকে ঘিরে । পর্যাপ্ত বর্ষায় প্রচুর ধানে মাঠঘাট যাতে সবুজে ভরে ওঠে, তাই সমস্ত চাষীরা একজোট হয়ে ঐ জঙ্গলের কোনো এক ধারে মা মনসার আরাধনা করে চলে বছরের পর বছর ধরে । পাকা ধান তোলার সময় প্রত্যেকে এক আঁটি করে পাকা ধান মাথায় করে মা মনসার থানে রেখে এসে মা'কে মিনতি জানায়: "মা গো, আমরা ছাপোষা মানুষ, দিন আনি দিন খাই, পেটের দায়ে চাষ করছি, আমাদের অপরাধ মার্জনা কোরো, সম্বচ্ছর সন্তানদের দুধেভাতে রেখো, পরের বছর যেন আবার চাষ করে তোমাকে ফসল দিয়ে পুজো দিতে পারি মা "
                               প্রায় চারশো বছর আগে জকপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায় একদিন ভোর রাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পেলেন । তিনি স্পষ্ট দেখেন, চতুর্ভুজা মা মনসা হাত নেড়ে নেড়ে তাকে বলছেন, ঐ জঙ্গলেই মা আছেন । জমিদার যেন মায়ের পুজোর প্রচার করেন ।



        ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে জমিদার কাঁপতে কাঁপতে ঘটি ঘটি জল খেয়ে স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে জমিদার বাড়িতে যে যেখানে ছিল হাজির হয়ে যায় । ঐ জঙ্গলের সাপের কথা সকলের জানা । মা মনসার থান বলে জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ । একথা সকলে প্রত্যক্ষ করেছে । সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর আদেশ দেন । ক্রমে কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে কিছুটা সাফ করে ফেলে । মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হতে থাকে । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে । উইঢিপিটিকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় । পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয় উইঢিপির মাটি দিয়ে । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে মনসার থানকে মর্যাদা দেন জমিদার যোগেশ্বর রায় । নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় সেখানে । 

পূজা দেওয়ার নিয়মাবলী


১ ) এই মন্দিরে বছরের সমস্ত দিনই মায়ের পূজা দেওয়ার প্রচলন আছে, তবে যেকোন শনিবার বা মঙ্গলবার হাজার হাজার পূণ্যার্থী পূজা দিতে আসেন । এছাড়া বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে পূণ্যাথীর ভিড়ে মন্দির প্রাঙ্গণ ক্ষুদ্র মেলার রুপ ধারন করে ।

২) এই মনসা মায়ের মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান সহ যে কোন ধর্মের মানুষ মায়ের পূজা করতে পারেন । নারী পুরুষ সকলেরই মন্দিরে প্রবেশাধিকার আছে ।

৩) মায়ের মন্দিরে পূজা দিতে গেলে সমস্ত পূণ্যাথীগণকে অবশ্যই স্নান বহ্বতে হবে এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে ।

৪ ) এই মন্দিরে কোন ব্রাহ্মণ দ্বারা পূজার ব্যবস্থা নাই । তাই পূণ্যার্থীগনকে নিজের হাতেই মায়ের পূজা করতে হয় ।

a) দক্ষিণার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে কোন প্রকার জুলুম নইি ৷ পূণ্যার্থীগন স্বেচ্ছায় যা প্রনামী দেন এবং অর্থদান করেন,তাতেই সারা বছর মায়ের নানা প্রকার উন্নয়নমূলক কাজকম হয় ।

৬) এই মন্দিরে কোন পণ্ডা নাই এবং পূজা বা মানত করার জন্য বাধ্যতামূলক কোন নিয়ম নাই ৷ পূণ্যাথীগনের যা মন চায়,তইি দিয়েই পূজা ও মানত করতে পারেন । মাত্র দূ-টাকার ধুপ, সিঁন্দুর ও পূজার ফুল দিয়েও কোন ভক্ত মায়ের পূজা বা মানত করতে পারেন ।

৭) মায়ের ভোগ রান্নার প্রচলন আছে এবং পূণ্যার্থীরা নিজেরাই রান্না করেন ।

রেলপথে কিভাবে যাবেন জকপুরের মহিশা গ্রামের মনসা মন্দিরে ?


খড়গপুর থেকে NH-2 ধরে কোলকাতার দিকে গিয়ে জকপুর রেলষ্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ডুবগোহাল স্কুলের পাশ দিয়ে ম‌ইশ্যা গ্রামের ভিতর দিয়ে মনসা মন্দিরে যাওয়া যায় । খড়গপুর স্টশন থেকে লোকাল ট্রেনে জকপুর বা মাদপুর স্টেশনে নেমে ট্রেকার বা ভাড়ার গাড়িতে মন্দিরে যাওয়া যায় । কোলকাতা বা হাওড়া থেকে লোকালে মাদপুর বা জকপুর নেমে এক‌ইভাবে মন্দিরে আসতে হয় ।

সড়কপথে কিভাবে যাবেন জকপুরের মহিশা গ্রামের মনসা মন্দিরে ?

 যাঁরা মেদিনীপুর শহর দিয়ে আসবেন, তারা মেদিনীপুর থেকে হলদিয়া, ডেবরাগামী (কোলকাতা) যে কোন বাসে কৃষ্ণনগর বাসস্টান্ড৷ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বা মোটর টলিতে করে তিন কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে পীচ রাস্তা দিয়ে আসতে হবে ৷ মেদিনীপুর থেকে যেকেউ চার চাকাতে সরাসরি মায়ের মন্দিরে আসতে পারেন ৷

 যারা মুম্বাই রোড দিয়ে মন্দিরে আসবেন, তারা কলকাতার দিক থেকে এসে মাদপুর বাসস্টান্ডে থেকে রেল স্টেশন হয়ে মন্দিরে আসতে পারেন ৷ 

চেন্নইি রোড দিয়ে এলে, চেন্নাই রোড থেকে জকপূরের কাছে মুম্বই রোড হয়ে কৃষ্ণনগর দিয়ে আসতে পারেন ৷ অথবা জকপুর রেল স্টেশন এর দক্ষিণ পাশ দিয়ে চারচাকা গাড়িতে ভুবগােহাল হাইস্কুলের পাশ দিয়ে, মইশা গ্রামের ভিতর দিয়ে মনসা মায়ের মন্দিরে আসতে পারেন ৷

বিশেষ তিথি কখন ? মেলা কবে হয় ?


প্রতিবছর চৈত্রমাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে এখানে মনসামায়ের মহাপূজা আর মেলা হয় । নিজের হাতে পুজো দেন দলে দলে পুণ্যার্থী । পশ্চিমবাংলায় গঙ্গাসাগরের মেলার পর এটি দ্বিতীয় বড় জনসমাগমের মেলা । সেই জমিদারের আমলে এই পুজোর রমরমা শুরু হতে থাকে । তারপর বৃটিশ সরকার মাদপুর থেকে জকপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করে।




বৃটিশদের রেলপথ নির্মাণ  ও এই মন্দির সম্পর্কিত লোককথা  

নীয় মানুষ বৃটিশদের অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়ে মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিল । সাহেবরা হেসে কুটিপাটি ! সেই কথা শুনে বলেছিল "হিন্দুডের ওয়াটার, স্কাই, ফায়ার, এসবের ডেব্‌টা আঠে । বাট্‌ স্নেকের ডেব্‌টা! হোয়াট ইজ দিস?" বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে । মানুষেরা সাহেবকে অনেক ভয় দেখাল এবং সম্মিলিত হয়ে বাধা দিল। তাদের বাধা তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার বাইরে থেকে আনা শ্রমিক দিয়ে বাহুবলের দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে অতঃপর সেই বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এসে ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন লাগিয়ে দিল জঙ্গলে । সর্পকুল বিনষ্ট হবে এই আশায় । কিন্তু বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেল তারা । তারপর জমিদার প্রজাদের সঙ্গে করে জঙ্গলের মধ্যে সরু রাস্তা কাটিয়ে অনায়াস যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আবার সশরীরে ফিরে এলেন প্রজাদের নিয়ে । মা মনসা নিজের মন্দিরে প্রবেশের পথ এইভাবে করে দিলেন ।

আমাদের সাহায্য করুন - 










কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.