Header Ads

gangani canyon । gangani region of west bengal । পশ্চিমবঙ্গের 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন'

চাই কেবল একদিনের ছুটি. এতেই হবে. চলো যাই টুক করে দেখে আসি, প্রকৃতি'র দারুন এক সৃষ্টি. আমাদেরই বাংলায়... The Grand Canyon of Bangla ! কলকাতা থেকে বেরিয়ে মাত্র তিন ঘন্টার ট্রেন সফর. ভোর ভোর বেড়িয়ে আবার রাতেই ফিরে আসা।



রেলপথে গনগনি

হাওড়া থেকে মেদিনীপুর গামী লোকালে মেদিনীপুর নেমে গাড়িতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা বা গড়বেতা গামী Express ট্রেন গড়বেতা থেকে 4 কিমি অটো বা টোটা তে যেতে হবে, কম খরচ।

সড়কপথে গনগনি
হাওড়া থেকে সকালে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে বা শালিমার থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেসে গড়বেতা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে টোটো তে প্রায় ২ কিমি গনগনি। গড়বেতা কলেজের কাছেই শিলাবতীর পাড়ে গনগনি। খড়্গপুর, মেদিনীপুর বা বিষ্ণুপুর থেকে বাসেও চলে আসা যায়। নিজস্ব গাড়িতে এলে সাঁতরাগাছি-আরামবাগ-কামারপুকুর-জয়রামবাটি-গড়বেতা এবং কলকাতা থেকে মুম্বাই রোড ধরে ভায়া বাগনান হয়ে উলুবেড়িয়া, সেখানে থেকে দুটি ভিন্ন রুট ঘাটাল-চন্দ্রকোণা টাউন-গড়বেতা অথবা খড়্গপুর থেকে NH- ৬০ ধরে ভায়া শালবনি।




gangani region of west bengal  

যখনই ভারতের কোন গন্তব্য সম্পর্কে 'ক্যানিয়ন' শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন প্রথম যে নামটি মনে আসে তা হল মহাবালেশ্বরের হিল স্টেশন। তবুও, ভারতের সবচেয়ে অস্বাভাবিক জায়গায় একটি পূর্ণাঙ্গ ঘাট রয়েছে যা প্রথম দেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণের অনুরূপ।


পশ্চিমবঙ্গের 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন' - গঙ্গোনি তে আপনাকে স্বাগতম। গড়বেতার ছোট শহরে অবস্থিত, লাল মাটির এই চিত্তাকর্ষক বিস্তৃত গিরিখাতটি সিলাবতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়ভাবে 'গঙ্গোনি ডাঙ্গা' বা 'গঙ্গোনি খোলা' নামে পরিচিত, এই ঘাটটি মাদার প্রকৃতির একটি হাতের কাজ যা বছরের পর বছর মাটির ক্ষয়ের সাথে নদী থেকে কিছু সহায়তার সাথে মিলিত হয়েছিল। ভূমিক্ষয় করতে করতে শিলাই এই জায়গাকে একটি অসাধারণ রূপ দিয়েছে। একদিকে লালমাটি, অন্যদিকে সান্ত শিলাবতী; সব মিলিয়ে গনগনির রূপ একবার দেখলে জীবনে ভোলার নয়। তিন ঋতুতে এর সৌন্দর্য তিনরকম। তপ্ত গ্রীষ্মে শিলাইয়ের বুক চিরে হেঁটে যাওয়া যায়। বর্ষায় শান্ত শিলাবতী হয়ে ওঠে স্রোতস্বিনী। তবে সবচেয়ে ভাল শীতে। এই সময় গনগনি যেন পূর্ণযৌবনা।

gangani canyon


ইতিহাসে গনগনি
মহাভারতে কিভাবে গনগনি সৃষ্টি তার কি উল্লেখ আছে ?

কথিত আছে এই নদীর পাড়েই পুরাকালে একটা গ্রাম ছিলো যার নাম ভিখগ্রাম। পান্ডরা তাদের অজ্ঞাতবাসের সময় এই ভিখগ্রামেই এসেছিলেন। অজ্ঞাতবাস এ থাকার সময় তারা এই গ্রামেরই এক ব্রাম্ভনের আশ্রয়ে ছিলেন। একদিন তারা দেখতে পেলেন সেই ব্রাম্ভনের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। তখন তারা ব্রাম্ভনের কাছে জানতে চাইলেন আপনারা সবাই কাঁদছেন কেন? তখন ব্রাম্ভন জানালেন এই শিলাই নদীর ওই পাড়ে যে জঙ্গল আছে সেখানে বক নামক এক রাক্ষসের বাস। প্রতিদিন তার খাওয়ার পালাকরে যোগায় এই গ্রামবাসিরা। সে প্রতিদিন একজন করে গ্রামের মানুষকে তার আহার হিসেবে গ্রহন করে। আজকে তার নিজের পালা তাই বাড়িতে শোকে সবাই কাঁদছে। যুধিষ্ঠির এই কথা শুনে ব্রাম্ভনকে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি যেনো দুশ্চিন্তা মুক্ত হন এবং ভীমকে পাঠালেন সেই রাক্ষস বধ করার জন্য। ভীম গিয়ে সেই রাক্ষস কে বধ করে। তখন নাকি প্রবল যুদ্ধ হয় বক রাক্ষস ও ভীমের মধ্য। তাদের সেই যুধ্যের ফলেই মাটি বসে গিয়ে নাকি সৃষ্টি এই গনগনি ক্যানিয়নের।  

তবে লোককথার পাশাপাশি জায়গাটি ঘরে ইতিহাসও রয়েছে।এ ছাড়াও এই অঞ্চলের কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে চুয়াড় বিদ্রোহ নিয়ে। চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৯ - ১৭৯৯) হল ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম বৃহৎ কৃষক বিদ্রোহ। চুয়াড় সম্প্রদায়ের মানুষেরা জঙ্গলমহল অর্থাৎ মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সিংভূম, মানভূম ও ধলভূমের স্থানীয় জমিদারদের অধীনে নায়েক বা পাইকের কাজ করতেন। কাজের বিনিময়ে তাদের জমি ভোগ করার অধিকার ছিল যাকে 'পাইকান জমি' বলা হত। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের জমির ওপর চড়া ভূমিরাজস্ব ধার্য করে ফলত তার বিরুদ্ধে জমিদারদের সাথে তাঁদের পাইক চুয়াড়গণও সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহ করেন। ইংরেজরা আদিম ও অন্ত্যজ জনজাতির এই কৃষকবিদ্রোহকে ঘৃনাভরে 'চূয়াড় বিদ্রোহ' নাম দেয়।
চুয়াড় বিদ্রহের প্রমুখ নেতৃবৃন্দরা হলেন রাজা জগন্নাথ সিং, রানী শিরোমনি, রঘুনাথ মাহাতো, গোবর্ধন দিকপতি, দুর্জন সিংহ, অচল সিংহ....। এই অচল সিংহই এই অঞ্চলে স্বদলবলে আত্মগোপন করে ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়েছিলেন। এখানেই তিনি রপ্ত করেন গেরিলা যুদ্ধকৌশল এবং সেই কৌশলেই ইংরেজদের ওপর প্রবল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন। কিন্তু ইংরেজরা কামানের সাহায্যে গোটা জঙ্গল জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। তখন অচল সিংহ চোরাগোপ্তা আক্রমন চালিয়ে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেননি। বগড়ির ক্ষমতাচ্যুত রাজা ছত্র সিংহ তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য ইংরেজদের সাথে হাত মেলায় এবং বিস্বাসঘাতকতা করে অচল সিংহ কে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেন। ইংরেজরা গনগনির এই মাঠেই নাকি অচল সিংহকে তার দলবল সমেত ফাঁসি দেয়।




ভূগোল -এ গনগনি -- 


এখানে অ্যারিজোনার জায়গায় গনগনি। আর কলোরাডোর জায়গায় শিলাবতী নদী। আর তারসাথে দীর্ঘ বছরের মাটির ক্ষয় অর্থাৎ আবহবিকারের ফলে এখানে সৃষ্টি হয়েছে ক্যানিয়ন বা অবিন্যাস্ত গিরিখাত ও উপত্যকা। আবহবিকার পরিবেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মাটি গঠন, ধংস ও পুনঃউৎপাদিত হয়। জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয় আবহবিকার, বিচূর্নিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব হয়। আমি যদিও ইতিহাসবিদ বা ভূবিজ্ঞানী নই তবুও ছোটবেলায় বই পড়ে যতটুকু মনে আছে তাতে দেখে মনে হলো এটা রাসায়নিক আবাহবিকার হলেও হতে পারে কারন শিলাস্তুপে বিভিন্ন খনিজ উপাদান থাকে এবং সেগুলি আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে। এই বিক্রিয়ার ফলে খনিজগুলির আকার, আয়তন, রং এর পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ বায়ুর বিভিন্ন গ্যাস, ভূপৃষ্ঠের জল ও অম্লের উপস্থিতিতে শিলাস্তর রাসায়নিক বিয়োজিত হলে, তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে। রাসায়নিক আবহবিকার বিভিন্ন প্রকার হয়: অঙ্গারযোজন, জলযোজন ইত্যাদি ।

কোথায় থাকবেন ? কি খাবেন ?

নদীর পাড়ে সরকারি উদ্যোগে এখানে একটা পিকনিক স্পট তৈরি করা হয়েছে সেখানে একটা শেড করা আছে, রান্নার রুম, বাথরুম ইত্যাদি আছে আর আছে বাসনপত্র ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা। কাছাকাছি হোটেল তেমন দেখলাম না। গড়বেতাতে থাকতে হবে। 

আমার অনুভূতি --

জানি জীবনেও এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এ যাওয়ার সৌভাগ্য হবে না তাই ভাবলাম সুযোগ যখন হাতে একবার এসেই গেছে তখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালে ক্ষতি কি? তাই না!!! সেই উদ্দ্যেশ্যেই এই গনগনি ঘোরার পরিকল্পনা।
আঁকাবাঁকা লাল মোড়ামের রাস্তা, পথের ধারে কাজুবাদামের বাগান, কানে হেডফোন...
তাতে গানবাজছে ______
'কালো জলে উছলা তলে ডুবল সনাতন
আজ চারানা কাল চারানা পাই যে দরশন।
লদীর ধারে চাষে বধু মিছাই কর আশ
ঝিরি হিরি বাকা লদী বইছে বার মাস....'

ভাবুন একবার এই situation এ কি অনুভতি হতেপারে। ফিলিংস কখনো বলে বোঝানো যায়না। গানের সাথে পরিবেশের এমন মেলবন্ধন নিজের চোখ-কান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। মনে হল- গানটা যেন এখানে বসেই লেখা। সত্যিই পাশ দিয়ে প্রকৃতির বুক চিরে ঝিরি ঝিরি বাঁকানদী ( শিলাবতী) বয়ে চলেছে আপন বেগে একদম শান্ত ভাবে। তার সাথে প্রকৃতি খোলা আকাশের নিচে মেলে ধরেছে তার দিগন্তের রুপের বাহার এ যেনো সত্যিই মেদিনীপুরের আয়না। হাঁটু জলা নদীতে ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বালুর চড়া যেন সত্যিই রাজকুমারীর ( শিলাবতীর) গলায় চন্দ্রা হার। আর গিরিখাত এর ওপর থেকে সরু আঁকাবাঁকা পথ জালের আকারে নেমে এসে যেন তার চুলের বাহার উদ্ভাসিত করেচলেছে।
প্রকৃতি আপন যতনে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। আর শিলাবতীর বাঁক ঠিক এইখানেই! তাই হয়তো গানে বলা হয়েছে 'যতন করে বাঁধলি মাথা তাওযে বাঁকা সিথা'। সারা বছর এই নদীতে কোথাও হাঁটু জল আবার কোথাও কোমড় সমান জল থাকে, কিন্তু বর্ষায় এর রুপ একদম উল্টো। তখন শিলাবতীর সেই ইচ্ছ্বল রুপ খুব ভয়ঙ্কর। দুকুল ভাসিয়ে দেয় প্লাবনে। ভূগোলের ছাত্রছাত্রী থেকে গবেষক, ভূমিক্ষয় নিয়ে গবেষণার জন্য অনেকেই এখানে আসেন। আর আমার মত ভ্রমনপ্রেমী মানুষদের কাছে গনগনি প্রকৃতির তৈরি এক নিপুণ শিল্পকর্ম।

অন্যদিকে,
ইংরেজরা গনগনির এই মাঠে অচল সিংহকে তার দলবল সমেত ফাঁসি দেয়।
শত শহিদের রক্তে রাঙানো এই ভূমি আমার কাছে যেন পূন্য ভূমি রুপে অভিহিত হতে লাগলো। তারা নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে নিজের প্রান পর্যন্ত দিতে পিছপা হননি।
তাদের সেই ত্যাগ ও বলিদানের কথা ভাবতে ভাবতে এতটাই তন্ময় হয়ে গেছিলাম যে কখন যে সূর্য্যটা তালসারি ও ঝোপজঙ্গলের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছিলো খেয়াল করতে পারিনি। হঠাৎ একঁঝাক পাখির কলকাকলিতে সম্বিত ফিরলো । তখন খেয়াল করলাম চারিদিক সূর্যাস্তের আবির মেখে লালে লাল। সবাই একে একে ফিরে যাচ্ছে। আমাকেও ফিরতে হল ।

 ভিডিও আসছে... সঙ্গে থাকুন । 



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.